সম্প্রতি ১১ জন বিশিষ্ট নাগরিক হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেটিকে ‘অমানবিক ও উসকানিমূলক’ আখ্যা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সংগঠনটির পক্ষে এটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বুধবার রাতে গণমাধ্যমে এক বিবৃতি দিয়েছেন।
বিবৃতিতে আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘দেশপ্রেমিক ও ধর্মপ্রাণ প্রতিবাদী জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে একদল গণবিচ্ছিন্ন তথাকথিত বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতিকে আমরা অমানবিক, উসকানিমূলক ও গণবিরোধী বলে সাব্যস্ত করছি। এই বিবৃতি স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের নির্লজ্জ দালালির প্রমাণ বহন করে।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে গত শুক্র ও রোববার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক তাণ্ডব চালান হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেলস্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেন হেফাজত কর্মীরা। ছবি: নিউজবাংলা
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার এক বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান দেশের শীর্ষস্থানীয় একদল লেখক-অধ্যাপক, সাংবাদিক-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী।
বিবৃতিদাতারা হলেন সাংবাদিক ও কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি সারওয়ার আলী, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সাংবাদিক আবেদ খান, লেখক-অধ্যাপক আবদুস সেলিম, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, লেখক ও প্রকাশক মফিদুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাহরিয়ার কবির ও লেখক-অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।
ওই বিবৃতিতে বিশিষ্টজনেরা বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে একাত্তরের বন্ধুদেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতীকী সফরকে কেন্দ্র করে যেভাবে দেশের সম্পদ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে দেশকে আবার পাকিস্তানি পথে নেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র মেলে ধরেছে।’
বিশিষ্টজনদের এই বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় পাঠানো বিবৃতিতে হেফাজতের আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের আহ্বানে দেশব্যাপী পালিত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও হরতালের কর্মসূচি চলাকালীন প্রতিবাদকারী আলেমসমাজ, মাদ্রাসার ছাত্র ও ধর্মপ্রাণ মানুষদের ওপর বিনা উসকানিতে পুলিশ কর্তৃক নির্বিচারে গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পুলিশের গুলিতে হত্যাকাণ্ডের নিন্দা না জানিয়ে একতরফাভাবে প্রতিবাদী জনতার গণপ্রতিরোধকে আপনারা তথাকথিত “তাণ্ডব” আখ্যা দিয়ে গণবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। ইসলামবিদ্বেষ ও সেকুলার মতাদর্শে আপনারা এতই অন্ধ যে, আপনাদের বিবৃতিতে পুলিশের গুলিতে শহিদ হওয়া ১৭ জন নাগরিকের প্রতি কোনো ধরনের মানবিক সমবেদনা প্রকাশ পায়নি। বরং আপনারা বিবেকবুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে দালালির নজরানা পেশ করতে প্রতিবাদী ধর্মপ্রাণ গণমানুষের ওপর “সর্বশক্তি প্রয়োগ”-এর আহ্বান জানিয়ে প্রকারান্তরে জালিম ক্ষমতাসীনদেরকে মানুষ হত্যায় উৎসাহ দিয়েছেন। এ জন্য ভবিষ্যতে আপনাদেরকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে ইনশা আল্লাহ।’
বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘যখন সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক ফেলানীসহ বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করা হয়, তখন আপনাদের বিবৃতি কোথায় থাকে? নিবর্তনমূলক ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে গ্রেপ্তার হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ সম্প্রতি কারান্তরীণ অবস্থায় মারা যাওয়ার পর আপনাদের কোনো বিবৃতি বা বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন কর্তৃক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারী নিরীহ ছাত্রদের ওপর নৃশংস হামলা হলে আপনাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেলেও আপনাদের টুঁ শব্দও শোনা যায় না। জনগণের কোনো ইস্যুতেই আপনাদেরকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। তাহলে আপনারা কোন মুখে নিজেদের “বিশিষ্ট নাগরিক” দাবি করেন? ক্ষমতাসীনদের দালালি ও মতাদর্শিক গোঁড়ামিতে বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে আপনারা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর হয়ে গেছে। পাকিস্তান এখন অতীত ইস্যু। আপনারা চিন্তা ও বুদ্ধিতে এতই পশ্চাৎপদ যে, আজও পাকিস্তানি জুজু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আছেন। ফলে পাকিস্তানি জুজুকে অতিক্রম করে সামনে এগোতে পারছেন না। বরং পাকিস্তান জুজুকে ছদ্মভাবে আপনারা ইসলামবিদ্বেষের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এই গণবিরোধী বিবৃতি আপনাদের ইসলামবিরোধী মুখোশ খুলে দিয়েছে। আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, এদেশ কখনোই পাকিস্তানের পথে যাবে না; কিন্তু আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী ভারতের করদরাজ্যে পরিণত করার চক্রান্ত আমরা গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলে নস্যাৎ করে দিবো, ইনশা আল্লাহ।’
আজিজুল হক ইসলামাবাদী আরও বলেন, ‘ভারত মূলত তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহায়তা করেছিল। তাই বলে কি গোলামি ও তাঁবেদারি করে ভারতের ঋণ শোধ করতে হবে আমাদের? আমাদের জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা দিল্লির গোলামি করার জন্য এদেশ স্বাধীন করেনি। আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, সার্বভৌমত্ব ও ইনসাফ কায়েম করার জন্যই তারা রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীন করেছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক হতে হবে সম-সার্বভৌমত্বের মর্যাদার ভিত্তিতে। গোলামি ও তাঁবেদারি করলে আমাদের জাতিগত আত্মমর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব ভূলুণ্ঠিত হয়—এই অবিসংবাদিত সত্য কথাটি আপনারা উপলব্ধি করার চেষ্ট করুন। এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দল-মতনির্বিশেষে লড়াই করতে আপামর জনগণ সর্বদা প্রস্তুত আছে। কোনো অপশক্তির হুমকি-ধমকিকে নায়েবে রাসূল ওলামায়ে কেরাম ও তৌহিদি জনতা পরোয়া করে না।